দেবাশিস দত্ত / আমার গাভাসকার

সুনীল গাভাসকারকে নিয়ে লেখা মানেই আনন্দ যেমন, সমস্যাও!
আনন্দ কারণ সেই ১৯৭৮ সাল থেকে পরিচয়। ৪৪ বছর হতে চলল। দেশে-বিদেশে কত ঘটনা, একসঙ্গে থাকা, ঘোরা, লেখা। সময়ে-অসময়ে ওঁকে বিরক্ত করা। হুটহাট ওঁর বাড়ি চলে যাওয়া মুম্বইতে, একেবারে পরিবারের লোক হয়ে ওঠার গল্পের মহাসাগর থেকে ছেঁচে কয়েকটা মুক্তো তুলে আনার চেষ্টা করতে হবে এই লেখায়, এমনই দাবি সম্পাদকের। আবার, সমস্যাও তো সেটাই! কতগুলো ঘটনা বলব, কীভাবে বলব? কী করেই বা মাত্র দু-একটা বেছে নেব? যাক গে, চেষ্টা করি!
প্রথমেই বলে রাখি, আমার দেখা শ্রেষ্ঠ মানুষেরও নাম সুনীল গাভাসকার। যেমন বুদ্ধি তেমন ঠাণ্ডা মাথা। উর্বর ক্রিকেট মস্তিষ্ক, সেটা তো না বললেও চলে। ক্রিকেট সংক্রান্ত যে কোনও টেকনিক্যাল প্রশ্ন উঠলে বরারবরই প্রথম ফোনটা করেছি তাঁকেই। তিনজনের শরণাপন্ন হই সাধারণত। গাভাসকার, জিওফ্রে বয়কট এবং গ্রেগ চ্যাপেল। তিনজন থাকেন বিশ্বের তিনটি প্রান্তে। টেকনিক্যাল কোনও একটা ইসু নিয়ে পরপর তিনজনকে ফোন করলে তিন প্রান্ত থেকেই মোটামুটি একই উত্তর পাওয়া যায়। সামান্য তফাৎ থাকে ঠিকই, তবে সেটা উপেক্ষনীয়। অবাক হয়ে যাই ভেবে যে, কী করে ওঁরা একই রকম বলতে পারেন, পরস্পরের থেকে এতটা দূরে থেকেও। আবার, উল্টোদিক দিয়ে ভাবলে অবাক হওয়ার তো কিছু নেই! ক্রিকেটের টেকনিক সম্পর্কে তিনজন এতটাই জানেন যে, ওঁরা একই রকম বলবেন এতে আর আশ্চর্য কী!
যাক গে, নিজের প্রসঙ্গে ফেরা যাক। গাভাসকারকে নিয়ে আমার অভিজ্ঞতার ঝুলি রামায়ণ-মহাভারতের মতোই বিশালকায়। অন্য যে কোনও লেখার মধ্যেই তাই যখনতখন উঠে আসেন তিনি। সেই ঝুলি থেকে দুটো বিশেষ গল্প বলি, আশা করি পাঠকদের পছন্দ হবে।

প্রথম, কেন এবং কীভাবে তাঁর নাম ‘সুনীল’ রাখা হয়েছিল? বেশিরভাগ মানুষই জানেন না। ছোটবেলায় গাভাসকাররা থাকতেন মুম্বইয়ের ভাটিয়া হাসপাতালের কাছে চিকলওয়াড়ি অঞ্চলে। একটা ছোট বাড়িতে। ইউ আকৃতির বাড়ি, মাঝে খেলার জায়গা, যাকে কষ্টেসৃষ্টে মাঠ বলা যেতে পারে! আর তার পাশেই একটা হনুমানজীর মন্দির, হিন্দিতে যিনি বজরংবলি নামেই পরিচিত। তা সেই পবনপুত্র হনুমানের বিরাট ভক্ত ছিল মনোহর-মীনাল গাভাসকারের একমাত্র পুত্র। এতটাই যে, তাঁর নাম ‘হনুমান’-ই রাখতে হবে, বাবা-মায়ের কাছে রীতিমতো জেদ করত সেই ছোট্ট ছেলে। অনেক ভেবে তাকে আটকানো হত বলে যে, এই নামে যখন স্কুল-কলেজে পরিচিত হতে হবে, নানা সমস্যা হতে পারে। বিশেষ করে নাম নিয়ে বিদ্রুপও শুনতে হতে পারে, যা একেবারেই কাম্য নয়। ছোট ছেলের বায়না অবশ্য সে সব শুনতে একেবারেই রাজি নয়। তখন উপায় খুঁজে বের করতে ‘হনুমান’ নামের প্রতিশব্দ খোঁজার চেষ্টায় লেগে পড়েছিলেন গাভাসকার-দম্পতি।
খুঁজতে খুঁজতেই পেয়েছিলেন ‘সুনীল’ নামের একটা মানে বজরংবলিও। ছেলেকে ডেকে বোঝানো হয়। অবশেষ মেনে নেয় একরত্তি ছেলে। বই খুলে দেখাতে হয়েছিল অবশ্য সে জন্য।
বিভিন্ন হনুমান মন্দিরে পুজো দেওয়া তখন নিত্য অভ্যাস। আরাধ্য দেবতার পুজো দিতেই হবে, একাত্তরে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে যাওয়ার আগে বিরাট চিন্তায় পড়েছিলেন এটা নিয়েও। অবশেষে ছোটবেলার এক বন্ধুর হাতে দশ টাকা দিয়ে গিয়েছিলেন। আর বলে গিয়েছিলেন, প্রতি শনিবার যেন নিয়ম করে তাঁর নামে পুজো দেওয়া হয়। মজার ব্যাপার হল, এতটাই ভক্ত হলেও, গত ৪৪ বছরের আলাপে তাঁর আরাধ্য দেবতাকে নিয়ে বিশেষ করে না খোঁচালে কখনও একটিও শব্দ ব্যয় করেন না তিনি!

আরও একটা গল্প বলি, ওই একাত্তর সিরিজের। সবাই জানেন, প্রথম টেস্ট সিরিজে বিদেশে, ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে ৭৭৪ রান করেছিলেন গাভাসকার। এখনও রানসংখ্যাটা মুখস্থ সবার। ওয়েস্ট ইন্ডিজে যেখানে প্রতিটি সমুদ্রসৈকতে বেড়ে ওঠেন ফাস্ট বোলাররা, যেখানকার পিচ মানেই ব্যাটসম্যানদের বধ্যভূমি, সেই ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ থেকে প্রথম টেস্ট সিরিজে ৭৭৪ রান! ক্রিকেটীয় আলোচনা তুলে রাখা যাক আপাতত সেই অসম্ভব কৃতিত্বের। সফর থেকে দেশে ফেরার পর মা মীনালের হাতে সুনীল তুলে দিয়েছিলেন একটি খাম। ওপরে লেখা ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ-১৯৭১। আর ভেতরে? ৭৭৪ টাকা। প্রতিটি রানের জন্য একটি করে টাকা। শুরু হয়েছিল এক অনবদ্য গল্প। প্রত্যেক টেস্ট সিরিজ খেলেন গাভাসকার আর শেষে বাড়ি ফিরে মায়ের হাতে তুলে দেন আরও একটি খাম। টেস্ট জীবনে গাভাসকারের রানের সংখ্যাটাও অনেকেই মনে রেখেছেন – ১০,১২২। প্রথম ব্যাটসম্যান হিসাবে টেস্টে দশ হাজার রানের সীমানা পেরিয়েছিলেন তিনি। সুনীলের মা মীনালের কাছে প্রতিটি খাম সযত্নরক্ষিত। এবং সব খামের টাকা মিলিয়ে ওই দশ হাজার একশো বাইশ টাকা।
গাভাসকারের মা মীনাল এখন থাকেন ওরলি সি ফেস-এর স্পোর্টসফিল্ড-এর ন’তলার ফ্ল্যাটে। বিরাট ২৮০০ স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাট। মুম্বইতে থাকলে গাভাসকার এখনও ওখানেই থাকেন। ‘আই’ (মা) মীনালের জন্মদিন ১৫ অগাস্ট। দেশে থাকলে যেখানেই থাকুন না কেন, সকালে এসে মা-কে প্রণাম করে আশীর্বাদ নিয়ে যাবেনই। এই মায়ের হাত ধরেই ক্রিকেটে স্ট্রেট ড্রাইভ মারার শিক্ষা গাভাসকারের। দোতলার বারান্দায় ছোট সুনীলের স্ট্রেট ড্রাইভে মায়ের নাক ফেটে রক্ত পড়েছিল। খেলা ছেড়ে মাকে নিয়ে পড়েছিল ছেলে। মা কিন্তু রক্ত মুছে আবারও বল করার জন্য প্রস্তুত। অত্যন্ত ঘাবড়ে যাওয়া সুনীল তখন আর খেলতে চাইছে না। মা-ই তাকে খেলতে বাধ্য করেছিলেন তখন, খেলার মাঠে অমন কতই তো হয়, বলে। প্রাথমিক শিক্ষা ওখানে বলেই সুনীলেক বনিয়াদ এতটা শক্ত। ভবিষ্যতে বিশ্বসেরা ফাস্ট বোলারদের বিরুদ্ধে খেলার সময় হেলমেটহীন গাভাসকার ছোটবেলাতেই জেনে গিয়েছিলেন, রক্তপাত হলেও ভয় পাওয়ার কিছু নেই। দৃঢ়চেতা হওয়া, কোনও পরিস্থিতিতেই ভয় না-পেতে শেখার শিক্ষা যে মায়ের কাছে! দুনিয়ার সব মা-ই চেয়ে থাকেন, ছেলে যেন সবার সেরা হয়ে ওঠে। ব্যতিক্রম ছিলেন না গাভাসকারের ‘আই’। আগলে রেখেছিলেন যেমন, ভুল করেননি প্রয়োজনীয় শিক্ষা দিতে, একেবারে ছোট বয়সেই।
আর দ্বিতীয় গল্পটা বাবা মনোহরের। বাবা ছিলেন উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান। ছুটির দিনে খেলতে যেতেন যখন, নিয়ে যেতেন ছেলেকে। ছোট ছেলে চেয়ারে বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ যেন পড়ে না-যায়, মনোহর বলতেন গল্প – চেয়ারগুলোকে উল্টো করে দিতাম, থুতনিটা চেয়ারের উঁচু হেলান দেওয়ার অংশে রেখে সুনীল খেলা দেখত আমাদের। দাদারের মাধবী নামের এক বাড়িতে ততদিনে চলে এসেছিলেন গাভাসকাররা। ওই বাড়ি থেকেই উত্থান। এখন সেই বাড়িটা আর নেই। একটা সময় মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষ বাসে-গাড়িতে চেপে আসতেন ওই বাড়িটা দেখার জন্য, যে বাড়ি থেকে উঠে এসেছিলেন ক্রিকেট ইতিহাসের সর্বকালের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ওপেনার। পরে মনোহর আবার চলে গিয়েছিলেন পুনে-তে। মৃত্যু হয়েছিল বেঙ্গালুরুতে, জামাই গুণ্ডাপ্পা বিশ্বনাথের বাড়িতে থাকাকালীন। গাভাসকারের বোন কবিতার স্বামী বিশ্বনাথ, ভারতীয় ক্রিকেটের আর এক রত্ন। এবং এই দুই ক্রিকেটারের বন্ধুত্বের গল্পগুলোও তো একই রকম আকর্ষণীয়।
যা বলছিলাম, বাবা মনোহর বলে গিয়েছিলেন বলেই, সুনীল কখনও রাজনীতিতে যাননি। একবার পরিস্থিতি এমন, জোর করা হয়েছিল পলিটিক্সে আসতে। যা করতেন এমন পরিস্থিতিতে বরাবর, বাবার কাছে গিয়ে জানতে চেয়েছিলেন সুনীল, কী করবেন। সোজাসুজি জানিয়েছিলেন বাবা মনোহর, যা বলেছিলেন সে দিন সুনীলকে, পরে গাভাসকার নিজেও এই লেখককে বলেছেন যেমন, সরাসরি ওঁর বাবার মুখেও শুনেছিলাম একই কথা। ‘মাই সন হ্যাজ প্লেড এ নোবল গেম। হোয়াই শুড হি বি ইনভলভড ইন এ ডার্টি গেম?’ (আমার ছেলে মহান খেলার সঙ্গে জড়িত, কেন সে নিজেকে নোংরা খেলায় জড়াবে?)
বাহাত্তর বছর বয়স হয়েছে, আগামী ১০ জুলাই চুয়াত্তরে পা দেবেন গাভাসকার। এত দিনে যখন পা রাখেননি রাজনীতির আসরে, সম্মান জানিয়ে এসেছেন বাবার উপদেশকে, আর সে-পথে পা বাড়াবেন না, নিশ্চিত।

বাবা-মায়ের প্রতি এই শ্রদ্ধা এবং সম্মান প্রদর্শনের প্রশ্নেও যে অদ্বিতীয় হয়েই রয়েছেন সুনীল গাভাসকার!
দেখতে দেখতে ৫০ বছর কেটে গেল তাঁর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট জীবনের। নিজেই অবাক হয়ে যান। এবং সবচেয়ে বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন যখন ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে প্রবেশ করে যখন ডানদিকের গ্যালারিতে চোখ রাখেন। তিনি যখন থাকবেন না, তখনও জ্বলজ্বল করে লেখা থাকবে সুনীল গাভাসকার স্ট্যান্ড। বছর দশেক আগে মুম্বই কর্তারা হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, দর্শকদের মনোরঞ্জনের জন্য তাঁর নামাঙ্কিত গ্যালারির অংশে মদ বিক্রি করা হবে। ক্লান্তির মাঝে গলা ভেজানোর উদ্যোগ? রে রে করে তেড়ে উঠেছিলেন মুম্বই-এর ক্রিকেটপ্রেমীরা যেখানে অধিকাংশ দর্শকই টিকিট কাটতে চাইছেন তাঁর নামাঙ্কিত স্ট্যান্ডে বসে খেলা দেখার জন্য। পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিলেন এমসিএ কর্তারা। মনে হয় না তাঁর জীবদ্দশায় এরকম কোনও প্রস্তাব আবার ধেয়ে আসবে তাঁর নামাঙ্কিত গ্যালারির অংশের জন্য।
৫০-তম বছর পূর্তি বছর উপলক্ষে মুম্বই ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের এখনকার কর্তারা অবশ্য তাঁকে সম্মান জানালেন একটি বিশেষ বক্স তাঁর নামে উৎসর্গ করে। সুনীল গাভাসকার সুইট। ওয়াংখেড়েতে আয়োজিত যে কোনও আন্তর্জাতিক ম্যাচে গাভাসকার তাঁর বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনদের নিয়ে ওখানে বসে খেলা দেখতে পারবেন। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বক্স। ওই সুইটে ঢোকার রাস্তা এবং ভেতরে চমৎকার সব ছবি রয়েছে তাঁর। এমনই তো হওয়া উচিত। রাজনীতিবিদ শরদ পাওয়ারের উদ্যোগে এভাবে সম্মানিত করা হল তাঁকে। এবং এক্ষেত্রেও তাঁর একটি মহানুভবতার ছোট গল্প রয়েছে।
এই সুইটের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের জমকালো আয়োজন করা হয়েছিল। টিটোয়েন্টি বিশ্বকাপের ধারাভাষ্য ছেড়ে তিনি দুদিনের জন্য মুম্বই এসেছিলেন। তবে শর্ত ছিল একটাই। এই সুইট উদ্বোধনের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির আসন দিতে চেয়েছিলেন গুণ্ডাপ্পা বিশ্বনাথকে। এ কথা তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, তাঁর চেয়ে অনেক বড় ব্যাটসম্যান হলেন আমাদের সবার প্রিয় ভিশি। বেঙ্গালুরুর ক্রিকেটার হওয়ায় ওয়াংখেড়েতে কোনও সুইট তাঁর নামে উৎসর্গ করা আইনে আটকাবে। তাই তিনি চেয়েছিলেন, ভিশিকে ওভাবেই সম্মান জানাতে। এমসিএ রাজি হয়ে গিয়েছিল। গত ৫০ বছর ধরে নিজের উচ্চতাকে মহানুভবতার রাংতায় মুড়ে ক্রমশ দীর্ঘায়িত করে চলেছেন। সেই কাহিনীগুলো, অন্য মঞ্চে তুলে ধরার ইচ্ছে রইল। আমি চাই আপনারা সবাই তাঁর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট জীবনের ৫০ বছর পূর্তি উৎসব উপলক্ষে শুভেচ্ছার ডালি সাজিয়ে অর্পণ করুন তাঁর উদ্দেশে।
থ্রি চিয়ার্স ফর সুনীল গাভাসকার, হিপ হিপ হুররে!
